অনুভবে অজন্তা/AJANTA THROUGH MY EYES

বিস্ময়! বিস্ময়! আর বিস্ময়! অপার বিস্ময় তাঁর সমস্ত স্থাপত্য ও ভাস্কর্য জুড়ে! শুরু থেকে শেষ, তার প্রতিটি আঁকেবাঁকে শুধুই অতি বিস্মিত বিস্ময়। কত অজানা ইতিহাস-শিল্প-শৈলী-পুরান কথা- নয়ন লোভন রঙিন ফ্রেসকো চিত্রকলা লুকিয়ে আছে সেই গুহার পরতে পরতে।  অর্ধচন্দ্রাকার অশ্বক্ষুরাকৃতি রহস্যময়ী   গুহাগুলি আলোড়ন তোলে মানসপটে।
লোকালয় থেকে বহুদূরে লোকচক্ষুর অন্তরালে কয়েক হাজার বছর আগে পার্থিব জীবনের বিষয়বস্তু নিয়ে চিত্রকারীরা গৌতম বুদ্ধের জীবনী ও জাতকের গল্পসমূহ যেভাবে  চিত্রে তুলে ধরেছেন তা অন্তহীন বিস্ময়কর। শুধু তাই নয়। যে অপ্রাকৃতিক গুহাগুলির নির্মাণকাজ  শুরু হয়েছিল দুশো খ্রিষ্টাপূর্বাব্দে, তা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে অব্যাহত ছিল ছশো খ্রিষ্টাব্দের পরেও।

      নাম তার অজন্তা। মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ জেলার জলগাঁওস্থিত অজন্তা গ্রামের প্রান্তে ইন্দ্রাদি পাহাড়ের পাথর কেটে খোদাই করা 30 টি গুহাস্তম্ভ নিয়ে অজন্তা। শৈশবে পাঠ্যপুস্তকে পড়া নামটা তখন ছিল শুধুমাত্র  একটা  ছবি। বুঝিনি তার নিবিড়তা। কাছে এসে আজ পরিচিত হলাম তার অসাধারণ অনন্ত ঐশ্বর্যের সাথে। নিমেষে  উজাড় হয়ে গেলো ইতিহাসের ভান্ডার। কৌতূহলী মন অতর্কিতে ঝাঁকিয়ে দেখে, কত অজানা, অদেখা বিলুপ্ত গল্পে ঠাসা সে ভান্ডার! নিজের অজান্তেই নিজে হারিয়ে গেলাম সুদূর অতীতে, হাজার হাজার বছর আগের বাকাতক হিন্দু রাজাদের আমলে।
কি অসীম নিপুণতায়, অপূর্ব কুশলতায়, একদল মানুষ, সম্ভবত বৌদ্ধভিক্ষু ছেনি ও গাইতি নিয়ে পাথুরে পাহাড় কেটে-খুঁড়ে করে চলেছে অনন্য সৃজন রাজা হরিসেনের পৃষ্ঠপোষকতায়।

     গুহাগুলির গভীরতায় বর্তমান গেলো হারিয়ে। একে একে চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে পরিত্যক্ত গুহাগুলি! দিনের প্রতিক্ষণের সূর্যালোক সব গুহাদারে ঠিকরে পরে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। 
আর সেই আলোয় গুহাতলে চলছে নানান কর্মযজ্ঞ। বৌদ্ধভিক্ষুদের পদচারণায় জমজমাট পরিবেশ।  কেউ ধ্যানমগ্না, কেউ পাঠরতা, কেউ শিক্ষাদানে ব্যস্ত, কেউ চিত্রাঙ্কনে, তো কেউ গুহার বাইরে নিচে দিয়ে প্রবাহিত ছিপছিপে সুন্দরী পাহাড়ি বাঘোড়া নদীতে স্নানে ব্যস্ত। অদ্ভুত এক শান্তি, অনাবিল এক তৃপ্তি সমস্ত গুহা জুড়ে। ভাগিদার হলাম আমিও, সেই তৃপ্তির। গুহার এক একটি চিত্র ও ভাস্কর্য যেনো কথা বলে! মানসপটে জীবন্ত গেঁথে যায় দুশো খ্রিষ্টাপূর্বাব্দের সামাজিক জীবনপালার ছবি।

     এমন সব অবিশ্বাস্য সৃষ্টি কিভাবে সম্ভব হলো ? প্রশ্নটা নিজের কানেই ফিরে ফিরে এলো। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের প্রথম ভাগেও যে গুহাগুলি  থেকে ভেসে আসত "বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি ,ধম্মং শরণং গচ্ছামি..." সেই শতকেরই  মধ্যভাগে দক্ষিণ ভারতের কলচুরি শক্তির হাতে বাকাতক সাম্রাজ্যের পতনের সাথে সাথে, সেগুলো পরিত্যক্ত হয়ে পড়লো। এক অলৌকিক অকল্পনীয় সৌন্দর্য ধীরে ধীরে ঢাকা পড়ে গেলো  বিস্মৃতির মোটা আবরণে।

     প্রায় হাজার বছরের বেশি সময় ধরে বুনো প্রকৃতি তার থাবা বসিয়ে ছিল এই গুহাগুলিতে। বাস ছিলো বুনো পশু-পাখির। স্থানীয় ভিল জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বিচরণ করতো সেখানে। গুহাগুলি থেকে গেলো পরের প্রজন্মগুলির অগোচরে। আধুনিক মানুষের কাছেও তাই থেকে যেতো যদি না 1817 (কেউ বলেন 1818/1819) খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ব্রিটিশ সেনা অফিসার জন স্মিথ বাঘ শিকার করতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত এই গুহার সন্ধান পেতেন।
এরপরই এখানে শুরু হয় প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান এবং অজন্তার রহস্য উন্মোচিত হয় সর্বসমক্ষে, শুধু ভারতেই নয়, বহির্বিশ্বেও।  1983 সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়  এই অজন্তা।

      গুহাপথে চলতে চলতে অনুভব করছিলাম শিল্পকলার প্রতি প্রাচীন মানুষগুলোর নিখাদ ভালোবাসা ও অপরিসীম  সহিষ্ণুতা বোধ। অনুভব করছিলাম নিজেদের রক্ত ঘাম ঝড়িয়ে কি অদ্ভুত একাগ্র চিত্তে তারা করেছিলো অপরূপ চিরস্থায়ী সৃষ্টি। তবে কি তারা  পরের প্রজন্ম, তারও বহু পরের, আমাদের, জন্য রেখে যেতে চেয়েছিলো এসব নিদর্শন!? হয়তো....!

      চকিতে ছেদ পড়লো ভাবনায়। সীমিত সময় অসমাপ্ত, মনে করিয়ে দিলো ভারপ্রাপ্ত সিকিউরিটির হুইসল। বিদায়ী মেঘ ঘন হয়ে এলো। ফেরার পালা। ফিরতে হবে একবিংশ শতাব্দীর মেকি সভ্যতার যুগে, বর্তমানে!! মনটা যেনো ডুকরে কেঁদে উঠলো। সহস্র  শতাব্দীর এমন নিদারুণ সুন্দরতা রাতের অন্ধকারের ঢাকা পড়ে যাবে! তবে পাথুরে ভালবাসা, পাথুরে ধ্বনি, পাথুরে কাহিনী জেগে রইলো। সকাল হতেই আবার শুরু হবে তার জয়গান, ভিন্ন পর্যটকদের চোখে ভিন্ন সুরে, ভিন্ন বিস্ময়ে।।

           সুস্মিতা দে

English translation:

Wonder! Wonder! And wonder! There is an Infinite wonder throughout all this architectures and sculptures! From the beginning to the end, its every nook and cranny is just a wonderful surprise. Such a  massive amount of history, art-styles and traditions, old- tales, eye-catching colorful fresco paintings are unknown & hidden in that cave. The mysterious crescent-shaped, horse-shaped caves stir the mind. The way in which the painters have portrayed the biography and birth of Gautam Buddha on the subject of worldly life, a few thousand years ago, behind the scenes far from the locality, is endlessly wonderful. Not only that... the construction of unnatural caves, which began in 200 BC, continued uninterruptedly after 600 AD.
It's Ajanta. Ajanta, that consists of 30 cave pillars carved out of Indradi hill at the edge of Ajanta village in Jalgaon, Aurangabad district of Maharashtra. The name I read in my childhood textbooks was just a picture. Its depth, intensity was unknown to me. But today I am amazed to see its extraordinary achievement. and got acquainted with its eternal splendor. The treasure of history was opened in an instant. The curious mind suddenly shakes! How much unknown, unseen extinct stories crammed within that treasure! Unbeknownst to me, I lost myself in the distant past, during the reign of the Bakatak Hindu kings, thousands of years ago. With infinite dexterity, wonderful skill, a group of people, probably Buddhist monks, have been digging the rocky hills with chisel and gaiti and creating eye-catching unique beauty under the patronage of Bakatak king raja Harisen.
I was  completely lost in the depths of the mysterious Ajanta. Abandoned caves are gradually coming alive in front of my eyes! The sunlight of the day is being scattered in all the caves. And in that light, various activities are going on in the cave. Quite a lively environment.  Buddhist monks are walking/ moving around. Some are meditating, some are reading, some are teaching, some are painting, some are bathing in the beautiful hilly river, Baghora,  flowing down the cave. A strange peace and joy, of pure contentment throughout the cave. I also plunged into that stream of joy. The cave paintings and sculptures are so perfectly made, it looks as if they are talking! Images of the social life of two hundred BC come alive in the mind.  
How is all this incredible creation possible? Such a brave thought of digging a cave and making a cave to worship and meditate in peace so far from the locality! Can't think. Even in the first half of the 6th century AD, "Buddhang Sharanam Gachhami, Dhammang Sharanam Gachhami ..." used to flow from the caves. In the middle of that century, the Bakatak kings were defeated by the Kalchuri power of South India. Since then the caves have been abandoned. A miraculous unimaginable beauty was gradually overshadowed by a thick veil of oblivion.

For more than a thousand years wild nature has been holding its paws in these caves.  Wild animals and birds made their shelter inside the caves. Local people of Will community used to roam there. Caves remained invisible to future generations. It would have been the same for modern people, were it not for John Smith, a British army officer in the Madras Presidency in 1817 (someone say 1818/1819), who had accidentally found the cave while hunting tigers. After that in 1829 officially archaeological expeditions began here and the mystery of Ajanta was unveiled to the public, not only in India but also abroad. Ajanta is declared a World Heritage Site by UNESCO in 1983.

Walking along the cave path, I could feel the pure love and immense tolerance of the ancient people towards art. I felt what a lot of hard work and sacrifices of them have rooted behind these wonderful caves. Did they want to leave a trace of their work for the next generation, much later, for us !? Maybe ....!

Suddenly the whistle of the security guard, in charge of the cave, was heard. Now it's time to return.
The farewell cloud thickened, mind seemed to cry. Such desperate beauty of the millennium will be covered by the darkness of the night!
But the Rocky love-sound-tale remained alive. Its triumph will start again from the morning, a beautiful note will create again, in different tourists' different moods, different colours, and different tunes!!!

           Susmita Dey

           03.07.2021

📸 credits: Susmita Dey